একজন প্রধান শিক্ষকের করুণ পরিণতি

19 September 2025, 12:38:30

 

মোঃ হাফিজুর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ
রূপসা কলেজ, খুলনা।

শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দে। আমার স্কুল জীবনের পরম শ্রদ্ধাভাজন একজন শিক্ষক। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় উনাকে অনেক কষ্টে লেখাপড়া করতে হয়। বি.এ. পাশ করার পর গ্রামের চারজন ও পার্শ্ববর্তী গ্রামের দুইজন তরুণ-যুবক মিলে সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করবেন। ‘বংকিরা জুনিয়র হাইস্কুল’ নামে ১৯৭৭ সালে স্কুলটির যাত্রা শুরু হলো। আমি পার্শ্ববর্তী স্কুল ত্যাগ করে ঐ বছরই সপ্তম শ্রেণিতে স্কুলটিতে ভর্তি হলাম। ধীরেন স্যার প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পেলেন। তৎকালীন জমিদার বাবু নিখিলেশ্বর বসুর পোড়ো বাড়িতে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হলো। পরের বছর (১৯৭৮) আমি যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, তখন স্যারেরা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের তিনজনকে ‘জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায়’ অংশ গ্রহণ করাবেন। প্রস্তুতি হিসেবে স্যারেরা আমাদেরকে বিনা বেতনে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করলেন। ধীরেন স্যার আমাদের অঙ্ক করাতেন। পরীক্ষার ঠিক দুই মাস আগে অনেকটা অভিমান করেই স্যার দেশ ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে গেলেন।

জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি পাওয়ার পর স্যারকে জানানো উচিত-এটা ভেবেই স্যারের সাথে প্রথম চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করি। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত (১৯৯০) চিঠির মাধ্যমে স্যারের সাথে যোগাযোগ ছিল।

তারপর রূঢ় বাস্তবতায় কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর স্যারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় (১৯৯১-২০২০)। কিন্তু স্যারকে কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। ফেইসবুকের কল্যাণে দীর্ঘ ত্রিশ বছর পর ২০২১ সালে আবার স্যারের সাথে যোগাযোগ হয়। স্ত্রীর সাথে স্যারের বিচ্ছেদ হয়েছে। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তাদের সাথেও স্যারের সম্পর্ক ভালো নেই। স্যারের চাকরি নেই। সহায় সম্বলহীন হয়ে গেছেন। বয়স বাড়ার পাশাপাশি অর্থ কষ্ট ও নিঃসঙ্গতায় স্যারের জীবন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে।

আলাপচারিতার এক পর্যায়ে স্যার দেশে ফিরে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবার দেশে এসে স্যার খুবই খুশী হলেন। কারণ এদেশে তাঁর অনেক ছাত্র-ছাত্রী ও শুভাকাঙ্খী রয়েছে, যাদের সাথে দেখা হওয়ার পর তারা স্যারকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। দুই মাস দেশে থাকার পর স্যার আবার ইন্ডিয়া চলে যান। সিদ্ধান্ত নেন জীবনের বাকী সময়টা তিনি এদেশেই কাটাবেন। কয়েকদিন পর স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবার স্যার দেশে ফিরে এলেন।

কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। এদেশে স্যারের জায়গা জমি নেই, হাতে কোনও টাকা পয়সাও নেই। থাকেন ভাইপোদের সাথে। তাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। দু’বেলা খাবার দেওয়ার সামর্থ্য থাকলেও থাকার জন্য আলাদা ঘর নেই। পরোক্ষভাবে তারা স্যারকে ইন্ডিয়াতে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল। বিষয়টি জানার পর আমরা কয়েকজন স্যারের থাকার জন্য একটি ঘর বানিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। দেড় লক্ষাধিক টাকা খরচ করে একটি ঘরসহ একজন মানুষের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হলো। স্যারের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থাও করা হলো।

বেশ ভালোভাবেই স্যারের দিন কাটছিলো। কিন্তু নিঃসঙ্গতা স্যারের জীবনকে দুর্বোধ্য করে তুলেছিল। হঠাৎ করেই স্যার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আবার টাকা সংগ্রহ করা হলো, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। সেন্সিটিভ জায়গায় অপারেশন করার প্রয়োজন হলো। অপারেশন করার পর স্যার অনেকটাই সুস্থ বোধ করলেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই স্যার আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মনে হয় বয়সের কারণে স্যার অপারেশনের ধাক্কা সামলাতে পারেন নি।

অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে গত ২২/৩/২৫ তারিখে স্যার ইহধাম ত্যাগ করলেন।

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো-স্যার এদেশে প্রায় ৩/৪ বছর অবস্থান করলেও তাঁর দুটি কন্যা একটি বারের জন্যও বাবার সাথে যোগাযোগ করেনি। এমনকি মৃত্যুর খবর জানার পরও তারা কোনও যোগাযোগ করেনি।

তাই তো মৃত্যুর আগে স্যারের শেষ অনুরোধ ছিল – তোমরা আমাকে দাহ করবে না, কারণ আমার ভেতরটা এমনিতেই মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়ে আছে!

বঙ্গ নিউজ ওয়েবসাইট থেকে কোনো তথ্য গ্রহণ করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আমাদের অনুমতি ব্যতীত বঙ্গ নিউজ ওয়েবসাইটের কোনো সংবাদ, ছবি, ভিডিও বা অন্যান্য কনটেন্ট হুবহু বা আংশিক কপি, সংরক্ষণ, ব্যবহার বা পুনঃপ্রকাশ করা আইনগতভাবে দণ্ডনীয়। এই ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড চিহ্নিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আমাদের কনটেন্ট ব্যবহার করতে চাইলে অনুগ্রহ করে আগে আমাদের লিখিত অনুমতি গ্রহণ করুন।

 বঙ্গ নিউজ কর্তৃপক্ষ