মুক্তির গানের গীতিকার মোহিনী চৌধুরী’র আজ জন্মদিন

বিধান চন্দ্র রায় /ঢাকা :
যে কোন সঙ্কটে দেশাত্মবোধক গান গাইতে যেয়ে আমরা গেয়ে উঠি,“মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান”। এটি একটি কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান, যা স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনাকে জীবন্ত করে তোলে। কিন্তু অনেকেই জানি না গানটির গীতিকার কে? গানটির গীতিকার মোহিনী চৌধুরী। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি এই গানটির সুরকার ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে।
“মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ হলো বলিদান” গানটি প্রথম রেকর্ড করেছে এইচএমভি (HMV) কোম্পানি। গানটির সুরকার ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে আগেই বলেছি । কণ্ঠ দিয়েছেন প্রখ্যাত বাঙালি সঙ্গীতশিল্পী সাহানা দেবী। গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩০-এর দশকে। এ গানটি জাতির জাগরণ,
বিপ্লবীদের আত্মত্যাগ ও বন্দীশালায় শিকল ভাঙার গান হিসেবে গণ্য করা হয়। জাতির মুক্তির জন্য তাদের বলিদানের কথা তুলে ধরে। এটি স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক অমর চিত্র। এই গানটি জাতীয় চেতনার এক অমূল্য রত্ন। গ্রামোফোন রেকর্ড ও সবাক চলচ্চিত্রে তার অজস্র গান শ্রোতা দের ভেতর খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তার কিছু গান আজো বাঙালির মুখে মুখে ফেরে।
মোহিনী চৌধুরী ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি গীতিকার, কবি ও চলচ্চিত্র পরিচালক । সাংসদ সচিব হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কিছু সময়।
তিনি গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার, ডহরপাড়া গ্রামে
জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ০৫ সেপ্টেম্বর। তাঁর পিতা ছিলেন মতিলাল চৌধুরী,ব্রিটিশ আমলে ডাক বিভাগে চাকরি করতেন।তাঁর পোষ্টিং ছিল মেসোপটেমিয়ায় মানে এখনকার ইরাকে। তাঁর মাতা ছিলেন গোলাপকামিনী দেবী গৃহবধূ। তাঁর সহধর্মিণী লীলা চৌধুরী ছিলেন একজন সফল গীতিকার। তাঁর বড় পুত্র ভবিষ্যত চৌধুরীও ছিলেন একজন গীতিকার। মেজো পুত্র দিগ্বিজয় চৌধুরী ছিলেন একজন সাংবাদিক ও প্রযোজক। মোহিনী চৌধুরী পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা পরে কলকাতায় চাকরি করতেন। ফলে পরিবারের সব সদস্যরা এখানে একত্রে বেহালায় বসতি গাড়েন।
মোহিনী চৌধুরী কলকাতার পঞ্চানন ইন্সটিটিউশন, সরস্বতী ইন্সটিটিউশন ও রিপন কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। রিপন স্কুল (সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এখান থেকেই আই. এসসি পাশ করেন তিনি । বি. এসসি তে ভর্তি হন একই কলেজে । গানের প্রতি মোহ গ্রস্থ হয়ে বি.এসসি পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখে গান লেখার সাথে যুক্ত হন। ১৯৪০ সালে চাকরি নেন ডাক বিভাগে। কলকাতা জিপিও তে তাকে পদায়ন করা হয়েছিল । তিনি আট বছর এই চাকরিতে ছিলেন। সিনেমার গীতিকারও পরিচালক হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়
ছেড়েছিলেন সে চাকরি।
মোহিনী চৌধুরীর ভাগ্যের চাকা ঘুরে যাওয়ার একটা মজার গল্প আছে। “এইচ এমবির কর্মকর্তা হেম চন্দ্র সেন তার দমদমের অফিস ঘর পরিস্কার করছিলেন। হটাৎ একটা খাতা পরে গেল তাক থেকে পায়ের কাছে। তুলে নিয়ে ধূলা ঝারলেন। দেখলেন লেখা আছে “গুঞ্জন” মোহিনী চৌধুরী ১৯৩৮ সাল, কোনো ঠিকানা ছিল না। মনে পড়লো একটা চিকন চাকন পাতলা মতো ছেলের কথা। অনেক দিন আসেনি তো সে। পৃষ্ঠা উল্টে চমকে ওঠেন এতো ভালো ভালো গান! এ-ই ছয় বছর পরে আছে খাতাটা। সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেন খাতাটা সুরকার কমল দাশ গুপ্তের কাছে। তিনি তখন খ্যাতিমান মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন রেডিওতে,গ্রামোফোনে। গীতি কবিতাগুলো পাঠ করে তিনি আয়োজন করেন মোহিনী চৌধুরীর প্রথম গানের রেকর্ডের ; সে গানের শব্দ চয়ন নীচে দেওয়া হলো।
“রাজকুমারী ওলো,
নয়নপাতা খোলো,
সোনার টিয়া ডাকছে গাছে
ওই বুঝি ভোর হলো । ”
গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন কুসুম গোস্বামী সুরারোপ করেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। তাকে ‘অভিনয় নয়’ ছায়াছবিতে শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রথম গান লেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। গীতিকার হিসেবে এই সুযোগ তাকে অনেক গতি এনে দিয়েছিল গানের জগতে। সেই সঙ্গে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। ১৯৪৩ সাল থেকে গ্রামোফোন, রেডিও ও চলচ্চিত্রের
গীতিকার হিসেবে স্বীকৃতি মেলে তার।
এরপর জিপিও’র চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সর্বক্ষণের জন্যে গানের জগতে মনোনিবেশ করেন মোহিনী চৌধুরী। রায়চৌধুরী, ঘুমিয়ে আছে গ্রাম, রংবেরঙ, সন্ধ্যাবেলার রূপকথা, একই গ্রামের ছেলে, ব্লাইন্ড লেন ইত্যাদি ছবিতে সহকারী চিত্র পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ছবি পরিচালনা আর
গান লেখা নিয়ে মশগুল ছিলেন তিনি। “সাধনা” ছবি নিজে প্রযোজনা করতে গিয়ে চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন তিনি। সহধর্মিণীর গয়নাগাটি সহ সকল সঞ্চয় ঢেলেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। পরে তিনি বিজ্ঞানী ও সাংসদ মেঘনাদ সাহার অধীনে সংসদীয় সচিবের চাকরি করেন কিছুকাল।
১৯৫৪ সালে শিল্পপতি ডি. এন ভট্টাচার্যের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করতে থাকেন। পরে প্রাইভেটে বি.এ পাশ করেন। ১৯৭১ সালে ডি.এন ভট্টাচার্যের ব্যবসা বিপর্যয় ঘটলে তার সে চাকরিটিও চলে যায়। শেষ জীবনে চরম আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হন এই জনপ্রিয় গীতিকার।
তার জনপ্রিয় গানের একটা তালিকা দেওয়া হলো।
মুক্তির মন্দির সোপানতলে
ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে
দিন দুনিয়ার মালিক তোমার দিল কি দয়া হয় না
জেগে আছি একা জেগে আছি কারাগারে
আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়
এনেছি আমার শত জনমের প্রেম
কাশ্মীর হতে কন্যাকুমারী
শতেক বরষ পরে
কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল
জয় হবে হবে জয়
সুন্দরী লো সুন্দরী, দল বেঁধে আয় গান করি
অভিনয় নয় গো, অভিনয় নয়
পিয়া সনে মিলন পিয়াস
ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে
চৈতি সন্ধ্যা যায় বৃথা
হায় কী যে করি এ মন নিয়া
কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল
সখি চন্দ্রবদনী, সুন্দরী ধনি
রাজকুমারী ওলো নয়নপাতা খোল
পৃথিবী আমারে চায়
তুমি যদি বলো ভালবাসা দিতে জানি না (গীতা দত্তের গাওয়া প্রথম গান)
শুনি তাকদুম তাকদুম বাজে বাজে ভাঙা ঢোল
কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল
আজ চঞ্চল মন যদি
তার লেখা গান গেয়ে জীবনে ধন্য হয়েছেন বহু শিল্পী।
কমল দাশগুপ্তের সুরে আর জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছিল বেশ কটি গান।
“ভুলি নাই ভুলি নাই,
আমি যে দুরন্ত বৈশাখী ঝড়,
ভালবাসা মোরে ভিখারী করেছে”
তিনি গানের পাশাপাশি সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছিলেন অনেক গুলো চলচ্চিত্রে। সেগুলো হচ্ছে ‘সাধনা’, ‘ঘুমিয়ে আছে গ্রাম’, ‘রংবেরঙ’, ‘সন্ধ্যাবেলার রূপকথা’, ‘একই গ্রামের ছেলে’, ‘ব্লাইন্ড লেন’ ইত্যাদি ।
১৯৫৪ সালে তিনি বিজ্ঞানী এবং সাংসদ মেঘনাদ সাহার সংসদীয় সচিবের পদ নিয়ে দিল্লী যান।
সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে মানাতে পারেননি তিনি। এরপর তিনি মেঘনাদ সাহার সংসদীয় সচিবের পদ ত্যাগ করে ফিরে আসেন কলকাতায়।
১৯৫৬ সালে তাঁর পরিচালিত ‘সাধনা’ ছবিটি মুক্তি পেলেও ব্যবসায়িক সফলতা থেকে বঞ্চিত হয়। এরপর শিল্পপতি দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের আহ্বানে
‘বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল-এ যোগদান করেন। এখানে তিনি দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের একান্ত সচিবের কাজ করেছেন। এরই মধ্যে তাঁর দুই বছরের শিশুপুত্র আগুনে পুড়ে মারা যায়। এ ঘটনা তাকে শোকাতুর করে রেখেছিল বহুদিন।
দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তখন বেশ কিছু সিনেমার প্রযোজক ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হেমন্ত তাঁকে ‘নায়িকা সংবাদ’ ছবির জন্য দুটো গান লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।তাঁর লেখা গান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি কী মিষ্টি এ সকাল’ আর ‘কেন এ হৃদয় চঞ্চল হল’ দুটো গানই অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। এর পর ‘শুকসারী’ ছবিতে উত্তম কুমারের জন্য লিখেছিলেন ‘সখি চন্দ্রবদনী, সুন্দরী ধনি…’ গানটি। এটিই ছিল মোহিনীর লেখা শেষ সাড়া জাগানো গান।
তবে, গীতিকার হিসেবে তাঁর অবদানকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি।কোনো সরকারি বা সাহিত্য
গোষ্ঠীর পুরস্কার তিনি পাননি জীবদ্দশায় বা মরণোত্তর কালে। তাঁর লেখা গানগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে বিশেষভাবে জনপ্রিয় ছিল। এখনও বাঙালি জাতির চেতনায় অমর হয়ে আছে তার লেখা গান। আর্থিকভাবে তিনি কখনও স্বচ্ছল ছিলেন না।*তাঁর ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ গানটি সেলুলার জেলে খোদিত হলেও গীতিকার হিসেবে তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি। *মোহিনী চৌধুরী ১০১ গানে গানে, প্রকাশ করেন তার পরিবারের সদস্যরা, মোহিনী চৌধুরির ১০১ তম জন্মশতবর্ষে। সংকলনে তার ১০১টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। *মোহিনী চৌধুরীর অবদানকে স্মরণ করে তাঁর পিতৃভূমি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় একটি সঙ্গীত একাডেমি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।
মূলত দেবেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের ওখানে চাকরিটা চলে গেলে তিনি ফের অসহনীয় দারিদ্র দশায় পড়েন। ১৯৮৭ সালে ২১শে মে তিনি চরম হতাশার মধ্যে
কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ৬৬ বছর বয়সে।
তিনি ছিলেন একজন খ্যাতনামা বাঙালি কবি, গীতিকার ও চিত্র পরিচালক। তার লেখা অনেক গান আজও বাঙালি হৃদয়ে অমর হয়ে আছে।
বঙ্গ নিউজ ওয়েবসাইট থেকে কোনো তথ্য গ্রহণ করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমাদের অনুমতি ব্যতীত বঙ্গ নিউজ ওয়েবসাইটের কোনো সংবাদ, ছবি, ভিডিও বা অন্যান্য কনটেন্ট হুবহু বা আংশিক কপি, সংরক্ষণ, ব্যবহার বা পুনঃপ্রকাশ করা আইনগতভাবে দণ্ডনীয়। এই ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড চিহ্নিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমাদের কনটেন্ট ব্যবহার করতে চাইলে অনুগ্রহ করে আগে আমাদের লিখিত অনুমতি গ্রহণ করুন।
বঙ্গ নিউজ কর্তৃপক্ষ

























মন্তব্য: