অমর প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকী

বিধান চন্দ্র রায় /ঢাকা:
বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিকের নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
২০১২ সালে তাঁর প্রয়াণের আগের চার দশক ধরে তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র স্মরণীয় গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি। একই সঙ্গে তিনি আধুনিক ও রোমান্টিক কবি । তার কবিতার বহু পঙক্তি সাধারণ মানুষ হৃদয়ের গভীরে ধারণ করে রেখেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় “নীললোহিত”, “সনাতন পাঠক”, “নীল উপাধ্যায়” ইত্যাদি অনেক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন লেখার সময় । সৃষ্টি করেছেন দুটি অসাধারণ চরিত্র কাকাবাবু ও নীল মানুষ (রণজয়)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম মাদারীপুরের কালকিনি থানার মাইজপাড়া গ্রামে ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর। জন্ম পূর্ববঙ্গে হলেও তিনি বড় হয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় । পড়াশোনা শুরু হয়েছিল টাউন স্কুলে, তারপর ভর্তি হন বীরমোহন স্কুলে। এখান থেকে মেট্রিক পাশ করেন। আই এ ক্লাসে ভর্তি হন সুরেন্দ্র নাথ কলেজে। পরে চলে আসেন সিটি কলেজে, মূলত এখান থেকে তিনি বাংলায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৫৪ সালে ।
তার বাবা সন্দেশ্বর গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সুনীলের মা করুণাময়ী দেবী কখনোই চান নি তার ছেলে শিক্ষকতা করুক। পড়াশুনা শেষ করে কিছুদিন তিনি বিভিন্ন অফিসে চাকুরি করেছেন। তারপর যোগ দিয়েছেন সাংবাদিকতায়। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটে তার। সেই সূত্রে মার্কিন মুলুকে ছিলেন সুনীল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে। ডিগ্রি হয়ে গেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেন সুনীল।
ইচ্ছে করলে থাকতে পারতেন, তার মন সায় দেয়নি তাই ফিরে এসেছিলেন দেশে। তবে সে সময়ের অভিজ্ঞতা তার কাজে লেগেছিল।
সহধর্মিণী স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনে এসেছিল ১৯৬৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। আর পুত্র সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায় এসেছিল পরিবার আলো করে ১৯৬৭ সালের ২০ নভেম্বর। সৌভিক বর্তমানে চলচ্চিত্র পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত।
লেখালিখিতে সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন তার বাবা
সন্দেশ্বর গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলের বাবা তাকে টেনিসনের একটা কাব্যগ্রন্থ দিয়ে বলেছিলেন, প্রতিদিন এখান থেকে দুটি করে কবিতা অনুবাদ করবে। এটা করা হয়েছিল এ জন্য যে তিনি যেন দুপুরে বাইরে যেতে না পারেন। তিনি তা-ই করতেন। বন্ধুরা যখন সিনেমা দেখত, সুনীল তখন পিতৃ-আজ্ঞা শিরোধার্য করে দুপুরে কবিতা অনুবাদ করতেন। অনুবাদ একঘেয়ে হয়ে উঠলে তিনি নিজেই লিখতে শুরু করেন। এ-ই হলো তাঁর লেখক হয়ে ওঠার গল্প।
নীললোহিত ছিল সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
অনেক ছদ্মনামের মধ্যে একটি । নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্তা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনিতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনিটি বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনিতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তার বয়স বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনিতে দেখা যায় নীললোহিত চির-বেকার। চাকরিতে ঢুকলেও সে বেশিদিন টেকে না। তার বাড়িতে মা, দাদা, বৌদি রয়েছেন। নীললোহিতের বহু কাহিনিতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়। যেখানে বহু শিক্ষিত, সফল কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ মানুষ একাকী জীবনযাপন করেন।
তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হচ্ছে ; সেই সময়,প্রথম আলো, একা এবং কয়েকজন ও পূর্ব- পশ্চিম।
তাঁর গদ্যের তালিকা বেশ দীর্ঘ; উল্লেখ যোগ্য কয়েকটি হচ্ছে ;কাজরী,সময়ের স্রোতে,এক জীবনে,
সময় অসময়,তিন চরিত্র,প্রেম ভালবাসা,বসন্ত দিনের খেলা,সেতুবন্ধন,বিজনে নিজের সঙ্গে,হৃদয়ে প্রবাস,
কোথায় আলো,এক অপরিচিতা,গড়বন্দীপুরের সে,
স্বপ্নের নেশা,ভালোবাসা,নিজেকে দেখা।
তাঁর কাব্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে, সুন্দরের মন খারাপ, মাধুর্যের জ্বর,সেই মুহুর্তে নীরা,স্মৃতির শহর,সুন্দর রহস্যময়,একা এবং কয়েকজন, আমার স্বপ্ন,জাগরণ হেমবর্ণ,আমি কিরকম ভাবে বেঁচে আছি,ভালোবাসা খণ্ডকাব্য,মনে পড়ে সেই দিন (ছড়া),নীরা, হারিয়ে যেও না, অন্য দেশের কবিতা,ভোরবেলার উপহার,
বাতাসে কিসের ডাক, শোন,রাত্রির রঁদেভু,সাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে,হঠাৎ নীরার জন্য।
তিনি বেশ কটি নাটক লিখেছিলেন,সেগুলো হচ্ছে
প্রাণের প্রহরী,রাজা রাণী ও রাজসভায় মাধবী,মালঞ্চ মালা,স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী।
তার লেখা গল্প গ্রন্থগুলো হচ্ছে ;শাজাহান ও তার নিজস্ব বাহিনী,আলোকলতার মূল,বরণীয় মানুষ : স্মরণীয় বিচার,আন্দামানে হাতিচোখ ও সেমুলি
আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য (প্রবন্ধ)
ইতিহাসে স্বপ্নভঙ্গ (প্রবন্ধ)ছবির দেশে কবিতার দেশে (প্রবন্ধ)রাশিয়া ভ্রমণতাকাতে হয় পিছন ফিরে (প্রবন্ধ)
কবিতার জন্ম ও অন্যান্য,সনাতন পাঠকের চিন্তা,
সম্পাদকের কলমে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসের কাহিনি চলচ্চিত্রে রূপায়ণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অরণ্যের দিনরাত্রি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাকাবাবু চরিত্রের চারটি কাহিনি সবুজ দ্বীপের রাজা, কাকাবাবু হেরে গেলেন?, মিশর রহস্য এবং পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। হঠাৎ নীরার জন্য তার চিত্রনাট্যে নির্মিত আরেকটি ছবি।
১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করতেন। ১৯৫৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন ‘এবং ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ করে । তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার। ১৯৮৫ সালে পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার।২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারিপুরের পক্ষ থেকে সুনীল সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয় ২০০৫ সাল থেকে।বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল গল্পের ওপর স্বীকৃতি প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিবস ০৭ সেপ্টেম্বরে সুনীল সাহিত্য ট্রাস্টের পক্ষ
থেকে এ আয়োজন করা হয়।
২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর তারিখে হার্টফেল করে তিনি মৃত্যুর মুখে ঢোলে পড়েন । ২০০৩ সালে ০৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’-কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দানের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দেহ দাহ করা হয় শেষ পর্যন্ত তার এক মাত্র পুত্র সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে। শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর।
বঙ্গ নিউজ ওয়েবসাইট থেকে কোনো তথ্য গ্রহণ করলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমাদের অনুমতি ব্যতীত বঙ্গ নিউজ ওয়েবসাইটের কোনো সংবাদ, ছবি, ভিডিও বা অন্যান্য কনটেন্ট হুবহু বা আংশিক কপি, সংরক্ষণ, ব্যবহার বা পুনঃপ্রকাশ করা আইনগতভাবে দণ্ডনীয়। এই ধরনের কোনো কর্মকাণ্ড চিহ্নিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমাদের কনটেন্ট ব্যবহার করতে চাইলে অনুগ্রহ করে আগে আমাদের লিখিত অনুমতি গ্রহণ করুন।
বঙ্গ নিউজ কর্তৃপক্ষ

























মন্তব্য: